নুসরাত হত্যা – একটি আজব দেশের আজব গল্প
ছোট বেলায় একটা সিনেমা দেখতাম “হীরক রাজার দেশে” – খুব জনপ্রিয় ছিল । আজব একটা দেশে রাজা মশাই আজব আজব সব কাজ করতেন । প্রজাদের উপর অত্যাচার করতেন আরো কত কি। অনেক দিন পার হয়ে গেছে । ছোট বেলার অনেক স্মৃতিই ম্লান হয়ে গেছে । কিন্তু হীরক রাজার দেশের গল্পটা কেন যেন বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছে আজ আমাদের এই ছোট্ট বাংলাদেশ। মানুষ নিয়মিত অগ্নি বিসর্জনের শিকার হচ্ছে, রাস্তায় চলতে থাকা মানুষ কে গাড়ির চাকা দিয়ে চিড়েচেপ্টা করা হচ্ছে, একদল মানুষ মরছে আর অন্য দল মোবাইল দিয়ে ছবি তুলছে, ফেইসবুক এ দেয়ার জন্য যাতে বেশি ফলোয়ার হয়, ধর্মের রক্ষক দ্বারা সবচে বড় অধর্ম হচ্ছে – প্রতিবাদ করলে আবার আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, ছোট্ট শিশু কন্যা তার বাবার মতো মানুষের দ্বারা অত্যাচারিত হচ্ছে । এতো কিছুর পরেও দেশ কিন্তু ঠিকই এগিয়ে যাচ্ছে – দেশে স্মার্ট ফোন এর জোয়ার, সোশ্যাল মিডিয়া রেভোলুশন, YouTube জেনারেশন – আরো কত কি।
কোনো দেশ ই পারফেক্ট না । রোড এক্সিডেন্ট, খুন, ধর্ষণ, আগুন, সন্ত্রাস এগুলো থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত দেশ গুলাও মুক্ত হতে পারেনি এখন পর্যন্ত । এগুলো সমাজ থেকে একবারে প্রতিকার করা সম্ভব না – যত দিন মানুষ থাকবে সমাজে, ততদিন এইসব সমস্যা থাকবে । কিন্তু দেখার বিষয় হলো যে একটা ঘটনা থেকে কতটা শিক্ষা নেয় একটা সমাজ। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেটার জন্য চেষ্টা করে। সাম্প্রতিক কালে নিউজিল্যান্ড এ সন্ত্রাসী হামলা হবার পর সে দেশে প্রধান মন্ত্রী এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন যা প্রসংশা করার মতো । যদিও এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ঘটনা ও প্রেক্ষাপট তারপর ও এটাকে একটা উদাহরণ হিসেবে নেয়া যেতে পারে যে কিভাবে একটা দেশ একটা দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে পারে ।
নুসরাত নামের হতভাগা মেয়েটার মতো এইরকম ঘটনা আমাদের দেশে নতুন না। নারী নির্যাতন এর পরিসংখ্যানে আমাদের দেশ বেশ অনেকটা এগিয়ে আছে –
– ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে দেশে ১৭২৮৯ টা ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।
– অ্যাসিড নিক্ষেপে আমাদের দেশ পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে প্রথম।
– শিশু ধর্ষণের হার আমাদের দেশে পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় বেশি।
– যৌতুকের কারণে অত্যাচারিত এবং হত্যার পরিমান প্রতি বছর বেড়ে চলেছে. ২০১৭ সালে এর সংখ্যা ছিল ৩৮৯।
নুসরাত হত্যার এই ঘটনাটি আমাদের দেশে বেশ সাড়া জাগিয়েছিল প্রথম কয়দিন । দেশে আন্দোলনের গণ জোয়ার, ফেইসবুক এ ঝড়, মানব বন্ধন – দেখে বেশ ভালো লাগলো আমার । কিন্তু দুঃখের বিষয় যে বরাবরের মতোই মাত্র দুই তিন দিনের ব্যবধানে ঘটনাটা চাপা পড়তে শুরু করেছে । সংবাদপত্রে প্রথম কয় দিন হেডলাইন হয়ে থাকার পর ধীরে ধীরে প্রথম পাতা থেকে দ্বিতীয় পাতা, তৃতীয় পাতা এবং সব শেষে একেবারেই হারিয়ে যাবে হয়তো। খোঁজ নিয়ে দেখুন, যে এই ঘটনাটি ঘটার ঠিক একই সময়ে সময়ে দেশে আনাচে কানাচে আরো অনেক গুলো ধর্ষন আর নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে – যা থেকে শিশু কন্যারাও নিস্তার পাচ্ছে না ।
আমাদের দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি হচ্ছে – শিক্ষা, প্রযুক্তি, ব্যবসা, শিল্প আরো বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সমৃদ্ধি চোখে পড়ার মতো। কিন্তু সামাজিক ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি খুবই শ্লথ । একজন গবেষক হিসেবে আমি ভেবে দেখি যে আমাদের সামাজিক সমস্যা গুলার বীজ কোথায়? যারা ধর্ষণ, নারী নির্যাতনের মতো ঘৃণিত অপরাধ গুলো করে, তার কি আসলেই চিহ্নিত অপরাধী বা অন্যান্য অপরাধ কর্মের সাথে জড়িত? বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেটা নয় – এই সম্যসা গুলোর গোড়াপত্তন হয় কুশিক্ষা থেকে, অথবা সুশিক্ষার অভাব থেকে । আমাদের দেশে শিক্ষার হার আগের থেকে অনেক বেড়েছে, কিন্তু সুশিক্ষার হার কতখানি বেড়েছে তা প্রশ্ন সাপেক্ষ । স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর পাঠ্যক্রম গুলোই এর সব থেকে বড় উদাহরণ – বাস্তবতার সাথে যা অত্যন্ত অসামঞ্জস্য পূর্ণ । প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান গুলোর অবস্থা কিছুটা ভালো হলেও, পাবলিক প্রতিষ্ঠান গুলোর অবস্থা খুবই করুন । মাদ্রাসা জাতীয় প্রতিষ্ঠান এর কথা তো বাদই দেয়া যাক – যেখানে ধর্ম শিক্ষা দেয়ার চেয়ে অধর্ম শিক্ষা দেয়া হয় বেশি ।
আলবার্ট আইনস্টাইনের একটা বিখ্যাত উক্তি আছে – Education is not the learning of facts, but the training of the minds to think. মোটা মোটা বই, নিত্য নতুন পাঠ্যসূচি, আর প্রযুক্তি ব্যবহার করলেই শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত হয় না। সুশিক্ষার ভিত্তি তৈরী করার জন্য আগে দরকার কিছু প্রগতিশীল, নিরপেক্ষ, মননশীল, জ্ঞানী মানুষের যাদের মধ্যে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কে প্রকৃতপক্ষে উন্নত করার আগ্রহ আছে । কোনো পলিটিকাল এজেন্ডা হাসিল করার জন্য নয় । একটা কথা মনে রাখা সবচেয়ে জরুরি – সুশিক্ষা মানুষকে স্বশিক্ষিত করে ।
মিডিয়ার একটা বড়ো ভূমিকা আছে এখানে – কিভাবে নিরপেক্ষ ও সত্যনিষ্ঠ খবর ছড়ানো যায় । যদিও আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে দেখছি যে হলুদ সাংবাদিকতায় বেশি প্রচলিত আমাদের দেশে । যায় হোক, আমাদের সকলের দায়িত্ব হলো আমাদের কথা ও কাজ দিয়ে সমাজে আলো ছড়ানো । কোনো সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট শেয়ার করার আগে ভেবে দেখা সেটা কিভাবে সমাজকে কলুষিত করতে পারে ।
সর্বশেষে, ধিক্কার জানায় মানুষরূপী পশু গুলোকে, যাদের দ্বারা নুসরাত এর মতো হাজার হাজার মেয়ে অত্যাচারিত হচ্ছে আমাদের সমাজে । তারাও কোনো মায়ের-ই ছেলে, বোনের-ই ভাই এবং কোন কন্যা শিশুর পিতা হবে হয়তো!
Image courtesy – https://twitter.com/hashtag/nusratjahanrafi?src=hash