স্ট্রেস বা মানুষিক চাপের ভালো ও খারাপ দিক – প্রতিকারের উপায়
গতিময় আমাদের এই জীবনে আর সব কিছুর সাথে একটা বাড়তি বিষয়ের ঝামেলা পোহাতে হয় – তা হলো স্ট্রেস বা মানুষিক চাপ। আমাদের প্রত্যাশার সাথে যখন প্রাপ্তির মিল হয় না, অথবা বাহ্যিক কোনো বিষয় আমাদের উপর বাড়তি চাপ ফেলে তখন আমরা স্ট্রেস অনুভব করি। আপাতঃ দৃষ্টিতে স্ট্রেস ক্ষতিকর মনে হলেও, তা সব সময় ক্ষতিকর নয়। কিছু স্ট্রেস আছে যা মানুষের সতর্কতা, শক্তি, কর্মক্ষমতা এবং উৎপাদনশীলতাকে বৃদ্ধি করে। জীবনে যদি স্ট্রেসের কোন ছোঁয়া না থাকে তবে আপনার প্রেরণাশক্তি এবং কর্মক্ষমতা কম হয়। স্ট্রেস সম্ভাব্য বিপদের বিরুদ্ধে শরীরকে সাড়াপ্রদান ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত করে, কর্টিসোল হরমোন নিঃসরণ করে, বিপাক এবং শ্বাসক্রিয়ার গতি বৃদ্ধি করে। মানুষের চিন্তাশক্তি ও কর্মক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে, জীবনকে করে গতিময় করে তুলে। তবে স্ট্রেস স্বল্পমেয়াদের জন্য ভাল – দীর্ঘ সময় ধরে যদি এই প্রতিক্রিয়া চলতে থাকে, তাহলে এটি আপনার মন এবং শরীরের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে ।
স্ট্রেসেরপ্রকারভেদ
স্ট্রেস বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে –
• ভালো স্ট্রেস (ইতিবাচক স্ট্রেস)
এই ধরনের স্ট্রেস আপনার জন্য ভাল। সাধারণত কোন চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া থেকে আসে এই স্ট্রেস। ফলে আমরা স্নায়বিকভাবে উত্তেজিত হয়ে পড়ি। এটি আপনার কর্মক্ষমতাকে উন্নত করার প্রেরণা এবং আপনার মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে এই ভালো স্ট্রেস।
• স্বল্পকালীন স্ট্রেস
স্বল্পকালীন স্ট্রেস কোন নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে পার করার একটি সংক্ষিপ্ত সময়কাল । নির্দিষ্ট পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সাথে সাথে স্ট্রেসও দূর হয়ে যায়। এই স্বল্পকালীন স্ট্রেসকে ইতিবাচকভাবে নিতে পারলে তা আপনার চিন্তাশক্তি ও কর্মক্ষমতাকে বহুগুণে বৃদ্ধি করতে পারবে।
• ক্রনিক বা চলমান স্ট্রেস
জীবনে চলমান চাপসমূহ যা আপনার চাহিদার থেকে সৃষ্ট হয়ে একটি দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে। উন্নতির সামান্যতম আশা হতে ক্রনিক স্ট্রেস সৃষ্টি হয়ে তা আপনার স্বাস্থ্য এবং সম্পর্কের জন্য খুব ক্ষতিকর হতে পারে ।শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য উভয়ের জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর হলো ক্রনিক স্ট্রেস ।
স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ
স্ট্রেস যেমন বিভিন্ন কারণে আমাদের অনুভূতির মধ্যে চলে আসে, ঠিক তেমনি স্ট্রেসকে নিয়ন্ত্রণও করা সম্ভব বেশ কিছু উপায়ে –
১. নিয়মিত শরীর চর্চা –
স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণে ব্যায়াম একটি কার্যকরী পন্থা। ব্যায়াম আপনার শরীরকে তৎপর রাখতে সহায়তা করে এবং ব্যায়ামের ফলে নিঃসৃত এন্ডোমোনস হরমোন আপনার স্ট্রেসকে কম করতে সাহায়তা করে। এছাড়াও ব্যায়াম আপনার পেশীগুলিকে শিথিল করবে। আর এই ব্যায়াম যে ব্যায়ামাগারেই করতে হবে তা কিন্তু নয়। আপনার কাছাকাছি জায়গায় প্রতিদিন হাঁটতে পারেন, জাম্পিং করতে পারেন অথবা YouTube দেখে ১০ মিনিটের একটি যোগব্যায়ামও করে ফেলতে পারেন।
২.পরিকল্পিত ভাবে জীবন যাপন করা
যখন আপনার অনেক কাজের চাপ থাকে এবং অনেকগুলো প্রয়োজনীয় কাজের ডেডলাইন পূরণ করতে হবে তখন একটি To Do List তৈরি করে সময় ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কাজ ভাগ করে নিতে পারেন। ফলে সময়মতো আপনার প্রতিটি কাজ সমাপ্ত করায় ফোকাস থাকতে পারেন। প্রথমেই বসে পড়ুন এবং আপনার যে যে কাজ করতে হবে সবকিছু লিখুন। এরপর কোন কাজটি অবশ্যই প্রথমে করতে হবে এবং কোনটি পরবর্তী সময় করলেও হবে বা কোন কাজটি অন্য কারোর ওপর দায়িত্ব দিলেও হবে তা ঠিক করতে হবে। প্রতিটি টাস্ক সম্পন্ন করতে কত সময় লাগবে এবং আপনার সময়সূচী থেকে তার জন্য কত সময় দিতে পারবেন তা ঠিক করুন।এভাবে সব কিছু লিখা রাখা স্ট্রেসকে বেশ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। পাশাপাশি শত ব্যস্ততা শর্তেও কিছু সময় বের করে নিজেকে পুরস্কৃত করুন কাজ সম্পন্ন করার জন্য।
৩. সঠিক খাদ্যাভ্যাস
খাদ্যাভ্যাস বা সঠিক ডায়েট আমাদের স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণে একটি বড় ভূমিকা পালন করে..দৈনন্দিন সুষম খাদ্য এবং সঠিক ডায়েট আমাদের অভ্যন্তরীণ শারীরিক প্রক্রিয়াকে সঠিক ভাবে পরিচালিত করে…খাদ্যের সাথে পর্যাপ্ত ঘুমও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়…দৈনিক ৭/৮ ঘন্টা ঘুম আমাদের শরীর কে সচল রাখে এবং আমাদের স্নায়ু গুলোকে সতেজ করে যা আমাদের এনে দেয় বাড়তি কর্মক্ষমতা।
৪. নিজেকে সময় দেয়া
যখন অতিরিক্ত চাপ বা স্ট্রেসের ফলে আপনি আপনার অনুভূতি ও আচরণে নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করবেন ,তখন কিছু সময়ের জন্য শুধু নিজের উপর মনোযোগ দিন। এমন কিছু করুন যা আপনি উপভোগ করেন, কোন বই পড়েন বা পছন্দের গান শুনুন, অথবা একজন বিশ্বস্ত মানুষ খুঁজে বের করুন যাকে আপনি আপনার অনুভূতি সম্পর্কে বলতে পারবেন । প্রতি সপ্তাহে আপনার সময়সূচীর মধ্যে কিছু ‘ নিজস্ব সময় ‘ রাখুন।সেই সময় আপনি আপনার উপভোগ্য কিছু করুন ও আপনার স্বাস্থ্যের যত্ন নিন। কিছু সময়ের বিরতি গ্রহণ আপনার মনকে সতেজ রাখবে ও সেইসাথে আপনার শক্তি মাত্রাকে পুনরায় বৃদ্ধি করবে। এই ধরণের কাজ আমাদের মনে একটা আলাদা প্রশান্তি নিয়ে আসে যা ডোপামিন এন্ড সেরোটোনিন হরমোন নিঃসৃত করে। ডোপামিন এন্ড সেরোটোনিন হলো এমন কিছু হরমোন যে নিউরোট্রান্সমিটার নাম পরিচিত এবং এগুলো আমাদের মধ্যে ইতিবাচক উদ্দীপনা জাগাতে সাহায্য করে।
৫. সোশ্যাল মিডিয়া ও প্রযুক্তির পরিমিত ব্যবহার
আমাদের জীবনে স্ট্রেস বাড়ানো বা কমানোর ক্ষেত্রে প্রযুক্তি – বিশেষ করে, সোশ্যাল মিডিয়া একটা বড় ভূমিকা পালন করে। এটা একদিক থেকে যেমন আমাদের উপকার করে, তেমনি আবার অনেক ক্ষতিরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমরা সত্যিকার সম্পর্কের বদলে মেকি বা কাল্পনিক সম্পর্কের দিকে বেশি ঝুকে পড়ি। তাই সোশ্যাল মিডিয়া কে এমন ভাবে ব্যবহার করুন যা আপনার উন্নয়নের কাজে লাগে।