বিষণ্নতা একটি মারাত্মক মানুষিক ব্যাধি – কারণ, উপসর্গ ও প্রতিকারের উপায়
বিষণ্নতা আমাদের অনেকের জন্যই একটি নিত্য দিনের সমস্যা। কেউ কেউ আমরা হঠাৎ করে কিছু সময়ের জন্য মনমরা ও দুর্বিষহ কষ্টে ভরাক্রান্ত হয়ে যাই। কারো কারো জন্য এটা ক্ষণস্থায়ী হলেও, কিছু মানুষ এই অনুভূতিগুলি দীর্ঘ সময় ধরে তীব্রভাবে অনুভব করে থাকে – হতে পারে সপ্তাহ, মাস কিংবা বছরের জন্য এবং কখনও কখনও আপাত কোন কারণ ছাড়াই । বিষণ্নতার ফলে মানুষ এক ধরনের হীনমন্যতায় ভোগে। আর এই হীনমন্যতা আপনার শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। বিষণ্নতা একটি মানুষিক সমস্যা যা একজন ব্যক্তির কাজ করার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। বিষণ্নতায় যদি আপনার মন প্রায়ই অপ্রসন্ন থাকে তবে তা একটি গুরুতর সমস্যা। এই সমস্যাকে আপনি আপনার জীবন থেকে বাদ দিতে পারবেন না তবে চিকিৎসার মাধ্যমে আপনি আপনার বিষণ্নতা কাটিয়ে উঠতে পারবেন ও ভাল অনুভূতি লাভ করতে পারেন। বিষণ্নতার সাধারণ কিছু কারণ হতে পারে যেমন – ব্যক্তিত্ব, নেতিবাচক চিন্তা করা, পারিবারিক জটিলতা, কর্মক্ষেত্রের জটিলতা, প্রিয় কোন মানুষ বা বন্ধুর মৃত্যু, আর্থিক অভাব-অনটন, নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন এবং সেইসাথে জীবনের কঠিন ও তিক্ত অভিজ্ঞতা।
বিষণ্নতা ধরন
বিষণ্নতা বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে , যেগুলো সৃষ্টির জন্য রয়েছে স্বতন্ত্র উপসর্গ এবং কারণ । আর এই বিভিন্ন ধরনের বিষণ্নতার জন্য বিভিন্ন চিকিৎসাও রয়েছে ।উপসর্গগুলি অপেক্ষাকৃত ছোট থেকে শুরু করে কিছু কিছু খুব গুরুতর হয়। তাই তাদের নির্দিষ্ট উপসর্গগুলি সম্পর্কে সচেতন হওয়া খুবই জরুরী। বিভিন্ন ধরনের বিষণ্ণতা –
- Main depression
Main depression-কে কখনও কখনও ক্লিনিকাল বিষণ্নতা বা ইউনিপোলার বিষণ্নতা অথবা সহজভাবে ‘ বিষণ্নতা ‘ বলা হয়। এই বিষণ্নতায় মানুষ তার স্বাভাবিক কার্যক্রমের প্রতি আগ্রহ ও আনন্দ হারায়, সেইসাথে বিষণ্নতার অন্যান্য উপসর্গগুলোও দেখা যায়। এই লক্ষণ সাধারণত দুই সপ্তাহের জন্য স্থায়ী হয় । ব্যক্তিজীবনের কার্মক্ষেত্র এবং সামাজিক সম্পর্ক সহ সবক্ষেত্রে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
- Melancholia
বিষণ্নতার একটি গুরুতর ধরন হলো এই Melancholia, যেখানে বিষণ্নতার শারীরিক অনেক উপসর্গ উপস্থিত থাকে। এর মধ্যে একটি প্রধান পরিবর্তন হলো, বিষণ্নতায় ভুক্তভোগী ব্যক্তিটি সবক্ষেত্রে খুবি শ্লথ গতিতে এগোতে শুরু করে । ফলে সবকিছুর মধ্যে থেকে প্রশান্তি হারিয়ে ফেলে এবং মেজাজী হয়ে উঠে।
- Psychotic depression
Psychotic depression এর ফলে মানুষ দৃষ্টিভ্রম বা বিভ্রমের শিকার হয়। তারা যে জিনিস নেই তাও দেখতে বা শুনতে শুরু করে অর্থাৎ মিথ্যা বিশ্বাসকে অনুসরণ করে।ফলে তারা ভীতু হয়ে যায় এবং তাদের চারপাশে সব খারাপ ঘটনা ঘটছে বা সবাই তাদের বিরুদ্ধে আছে এরকম মনোভাব পোষণ করে।
- Antenatal and postnatal depression
গর্ভাবস্থায় মহিলাদের ক্ষেত্রে বিষণ্নতার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। গর্ভকালীন বিষণ্নতা antenatal এবং প্রসবকালীন বিষণ্নতা postnatal হিসেবে পরিচিত। এছাড়াও ‘perinatal’ শব্দটি ব্যবহার করা হয় গর্ভাবস্থার সময়কাল এবং শিশুর জন্মের পরে প্রথম বছরের বিষণ্ণতাকে বোঝাতে । শিশুর জন্মের পরপরেই, অনেক মহিলার একটি সাধারণ শর্ত হল ‘বেবি ব্লুজ’ যা হরমোনীয় পরিবর্তন এবং এই হরমোনের পরিবর্তন প্রায় ৮০শতাংশে মহিলার ওপর প্রভাব ফেলে । ‘বেবি ব্লুজ’ অথবা সাধারণ স্ট্রেস গর্ভাবস্থা এবং একটি নতুন শিশুর জন্ম দেওয়ায় একটি সাধারণ অভিজ্ঞতা, তবে তা বিষণ্নতা থেকে ভিন্ন । বিষণ্নতা খুব বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং এটা শুধুমাত্র মায়ের উপরই প্রভাব ফেলে না, বরং মায়ের সাথে তার সন্তানের সম্পর্ক, সন্তানের বিকাশ , মায়ের সাথে তার সঙ্গীর সম্পর্ক এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে সম্পর্কেও প্রভাবিত করে ।গর্ভধারণের সময় প্রায় ১০ শতাংশ নারী বিষণ্নতা অনুভব করবেন । এর ফলে গর্ভকালীন সময়ের প্রথম তিন মাসে এই বিষণ্ণতা বেড়ে যায় ১৬ শতাংশে।
- Bipolar disorder
Bipolar disorder “অবসাদগ্রস্থ বিষণ্নতা” হিসাবে পরিচিত। এই বিষণ্নতার তীব্রতর উপসর্গের মধ্যে রয়েছে -ভাল বোধ করা, প্রচুর শক্তি থাকা, রেসিং চিন্তা এবং সামান্য সময় ঘুমানো, দ্রুত কথা বলা, কাজের উপর অমনোযোগী হওয়া, হতাশা এবং মেজাজ খিটখিটে হওয়া। এটি একটি দীর্ঘকালীন অভিজ্ঞতা। এর ফলে মাঝে মাঝে মানুষ বাস্তবতার স্পর্শ হারায় এবং মনব্যাধিতে আকান্ত হয়। Bipolar disorder সৃষ্টিতে পারিবারিক জটিলতায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর ভূমিকা রাখে। এটি বিষণ্নতা, নেশাজাতীয় দ্রব্যের (এলকোহল বা ড্রাগে)অপব্যবহার, হাইপারঅ্যাক্টিভিটি ডিসঅর্ডার (এডিএইচডি) বা সিজোফ্রেনিয়ার ভেবে ভুল করে। এটি সবচেয়ে ক্ষতিকর এবং আপনি যদি Bipolar disorder ঠিক করতে চান তাহলে আপনাকে অবশ্যই ডাক্তার বা স্বাস্থ্য পেশাজীবীর শরণাপন্ন হতে হবে ।মোট জনসংখ্যার প্রায় 2 শতাংশ মানুষ এই Bipolar disorder এ ভুগছে ।
- Cyclothymic disorder
Cyclothymic disorder প্রায়ই Bipolar disorder এর একটি শান্ত রূপ হিসেবে ধরা যায় । যে ব্যক্তি অন্তত দুই বছর ধরে দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতার ভুগছে তার মধ্যে এই বিষণ্ণতা দেখা যায়। উপসর্গের সময়কাল স্বল্প (দুই মাসের বেশি নয়), কম গুরুতর এবং নিয়মিত নয়।
- Dysthymic disorder Dysthymia
এর লক্ষণগুলো Main depression ন্যায় কিন্তু কম গুরুতর । তবে এক্ষেত্রে, উপসর্গগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয় । একজন ব্যক্তির এই ধরনের বিষণ্নতায় দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে ভুগতে থাকে, যা Dysthymia হিসেবে ধরা হয় ।
- Seasonal affective disorder (SAD)
SAD একটি মেজাজী ব্যাধি যা মৌসুমি ধরনের হয় । এই রোগের কারণ অস্পষ্ট, কিন্তু বিভিন্ন ঋতুতে হালকা বৈচিত্র্যের সাথে প্রকাশিত হয় । এটি একটি নির্দিষ্ট সময়কাল যেমন -ঋতুর শুরুতে শুরু হয়ে এবং ঋতু শেষ হওয়ার সাথে সাথে তা সাধারণ অবস্থায় ফিরে আসে। যখন কয়েক বছর ধরে একই উপসর্গ দেখা দেয়, তখন এই ডিসঅর্ডারটি সাধারণত ধরা পড়ে । বিষণ্নতায় মানুষ শক্তির অভাব অনুভব করে, ঘুম অত্যধিক বেশি হয়, অতিরিক্ত খাদ্যগ্রহণ করে, ওজন বাড়ে এবং কার্বোহাইড্রেটও বাড়ে।
বিষণ্নতার উপসর্গ
বিষণ্নতাকে মানুষ বিভিন্নভাবে অনুভব করে। বিষণ্নতার সাধারণ উপসর্গের মধ্যে রয়েছে-
মেজাজ
- মনমরা বা খিটখিটে হয়
- নিরুৎসাহিত হওয়া বা অসহায় বোধ করা
- নিজেকে সবকিছুর জন্য নিজেকে দোষারোপ করা ও দোষী মনে করা
- নিজের কাজেকে উপভোগ করতে অক্ষম
- সব বিষয়কেই নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে মনে হওয়া
- সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে জটিলতা অনুভব করা
- আত্মহত্যা বা নিজের-ক্ষতির চিন্তা করার
ব্যবহার
- প্রেরণাশক্তি এবং বাহ্যিক শক্তির অভাব বোধ করা
- পছন্দের কাজগুলোর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলা
- বন্ধু এবং পরিবারের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়া
- অন্যের উপর অধিক নির্ভরশীল হওয়া
- নেশাজাতীয় দ্রব্যের সেবন বৃদ্ধি করা
- স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মেজাজী হওয়া
শারীরিক অবস্থা
- ক্ষুধা কমে যাওয়া বা বেশি খাওয়া
- ঘুমের সমস্যা – ঘুম পেতে অসুবিধা, মধ্যরাতে জেগে ওঠা বা দীর্ঘ সময়ের জন্য ঘুমানো
- মাথাব্যথা ও পেট ব্যাথা করা
- শারীরিকভাবে দুর্বল অনুভব করা
- যৌন আগ্রহের অভাব
বিষণ্ণতা নিয়ন্ত্রণ
বিষণ্ণতা নিয়ন্ত্রণ করার কিছু উপায় হলো –
- ভবিষ্যৎ সম্পর্কে খুব বেশি চিন্তা করবেন না।
- বড় কাজগুলোকে ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত করুন এবং আপনি যতটুকু করতে পারবেন তাই করুন, নিজের উপর কঠোর হবেন না।
- পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে সময় কাটান এবং আপনার অনুভূতিগুলো সম্পর্কে তাদের সাথে কথা বলুন।
- সামাজিক বা কমিউনিটি গ্রুপে যোগ দিন;
- নতুন কোন শখ নিয়ে কাজ করুন
- নিয়মিত ব্যায়াম করুন এবং স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করুন।
- আপনার বিষণ্ণতায় চিকিৎসা নিন।
- একা নীরব থাকবেন না । প্রয়োজন হলে কারও সঙ্গে কথা বলুন ।
- এমন কিছু দেখুন বা পড়ুন যা আপনাকে এটি বাচক হতে অনুপ্রেরণা যোগাবে (মোটিভেশনাল ভিডিও, ভালো বই, পসিটিভিটি ব্লগ) ।
যদি উপরের কোনো তাই আপনার বিষন্নতা কে কমাতে বিনা পারে তাহলে একজন মনো বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়াটাই সবচেয়ে কার্যকরী হবে ।